ঊর্মির হঠাৎ পরিবর্তনে অবাক স্বজন, সহকর্মী

ডেস্ক রিপোর্ট ::লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনের সদ্য বরখাস্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম ঊর্মির আকস্মিক পরিবর্তনে হতবাক তাঁর স্বজন ও সাবেক সহকর্মীরা। ঊর্মির অতীত কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ ছিল না। এমনকি ছাত্রজীবনেও তিনি কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাঁর পরিবারও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। কয়েক দিন ধরেই তাঁকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ফেসবুকে বিতর্কিত পোস্ট দেওয়ায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তাঁকে। এবার তাঁকে বিভাগীয় ও ফৌজদারি– উভয় মামলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৬ অক্টোবর ঊর্মিকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হলেও তিনি সেখানে যোগদান করেননি। ৭ অক্টোবর তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গত তিন দিনেও তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করেননি। তিনি পলাতক আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরিবারের সঙ্গেও তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই বলে জানা গেছে।

সামাজিক মাধ্যমে বলা হচ্ছে, ঊর্মি ভারত চলে গেছেন। কেউ বলছেন, উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন তিনি। তবে এ বিষয়ে গতকাল বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঊর্মি বিদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে অনুমতি চেয়ে কোনো আবেদন করেননি। তিনি ভারতে চলে গেছেন কিনা বা এখন কোথায় আছেন– এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনো ধারণা নেই। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনু বিভাগ) বাবুল মিঞা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাময়িক বরখাস্ত হলেও ঊর্মি এখনও সরকারি কর্মকর্তা। সরকারের বিনা অনুমতিতে তাঁর বৈধভাবে দেশের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে চাকরিকালে ঊর্মি সৎ ও ভালো অফিসার হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর আচরণে কোনো দল বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়নি।

লালমনিরহাটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আফরোজা খাতুন সমকালকে জানান, গত ১৪ আগস্ট জুডিশিয়াল মুন্সিখানা শাখায় (জিএম শাখা) ঊর্মি যোগদান করেন। এর আগে তিনি জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন শাখায় দায়িত্ব পালন করেন। জিএম শাখা অফিসের দায়িত্ব তিনি সঠিকভাবেই পালন করেছেন। এ সময় তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। ফেসবুকে তিনি কী লিখেছেন, কেন লিখেছেন তা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত। এ ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারছি না।

ঊর্মি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার সদর ইউনিয়নের নসিবপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের মেয়ে। তাঁর বাবা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা শহীদ স্মৃতি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসরে।

দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ঊর্মি সবার বড়। তাঁর ছোট ভাই জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন। মা নাসরিন জাহান বর্তমানে ময়মনসিংহের হাজী কাশেম আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজে গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

ঊর্মি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে লালমনিরহাটে যোগদান করেন। ৪০তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারভুক্ত হয়ে তাঁর চাকরি জীবনের শুরু এই জেলা থেকেই। তিনি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে বিএসসি পাস করেন। ২০১৮ সালে এমএসসি সমাপ্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি বিবাহিত ছিলেন। পরে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে ঊর্মি তাঁর আইডিতে লিখেছেন, ‘সাংবিধানিক ভিত্তিহীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রিসেট বাটনে পুশ করা হয়েছে। অতীত মুছে গেছে। রিসেট বাটনে ক্লিক করে দেশের সব অতীত ইতিহাস মুছে ফেলেছেন তিনি। এতই সহজ। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে আপনার, মহাশয়।’

এই পোস্টটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ঊর্মি। এ ঘটনায় ৬ অক্টোবর তাঁকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। এর পর ৭ অক্টোবর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এর পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কটূক্তি ও আবু সাঈদকে ‘সন্ত্রাসী’ বলার আরও কয়েকটি স্ট্যাটাস ভাইরাল হয় ঊর্মির। এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা। ঊর্মিকে গ্রেপ্তারের দাবিতে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনেও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।

তবে চাকরি থেকে ওএসডি হওয়ার পরও  ঊর্মি অবস্থান বদলাননি। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে যে কোনো জায়গা থেকে বলা যায়। এ জন্য যদি চাকরি চলে যায়, এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি যখন দেখব, আমার দেশের ওপর কোনো থ্রেট চলে আসছে, দেশকে বাঁচানোর জন্য আমার যতটুকু বলা উচিত, সেই বলাটাই আমার দায়িত্বশীলতা।’ ঊর্মি এখনও সামাজিক মাধ্যমে সরব। এমনকি নিউজ ফিডে গিয়ে তাঁকে মন্তব্য করতেও দেখা গেছে।
ঊর্মির মা শিক্ষিকা নাসরিন জাহান বলেন, ‘মেয়ে একটি অপরাধ করে ফেলেছে। এভাবে কথা বলে সে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করেছে। তিনি বলেন, যে যুদ্ধ হয়েছে, সেটা ইতিহাস। ইতিহাসকে অস্বীকার করার উপায় নেই।’

ছিলেন না কোনো ছাত্র সংগঠনে
ঊর্মি ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। তখন তাঁর ৪০তম বিসিএস পরীক্ষা ছিল। ঊর্মির মা বলেন, ‘আমার কোনো সন্তানই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। আমরা খুব সাধারণ জীবনযাপন করি।’

জানা গেছে, ১ সেপ্টেম্বর রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার থেকে পাসপোর্টের জন্য এনওসি নেন ঊর্মি। সম্প্রতি তাঁকে ‘হায়ার স্টাডি অ্যাবরোড’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হতে দেখা যায়। তবে গত দু’দিন তাঁর আইডিতে ঢুকে কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
খুলনার আদালতে মামলাখুলনা ব্যুরো জানায়, ঊর্মির বিরুদ্ধে খুলনা মহানগর হাকিম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও প্রধান উপদেষ্টার ১ হাজার কোটি টাকার মানহানির অভিযোগে মামলা হয়েছে। নগরীর বয়রা ক্রস রোডের বাসিন্দা মোল্লা শওকত হোসেন বাবুল বাদী হয়ে বুধবার দুপুরে মামলাটি দায়ের করেন।

বাদীর আইনজীবী মাসুদুর রহমান জানান, আদালত বাদীর আর্জি গ্রহণ করে সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ১৫ ডিসেম্বর মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।
লালমনিরহাট থানায় অভিযোগ
ঊর্মির বিরুদ্ধে লালমনিরহাট সদর থানায় অভিযোগ দায়ের  হয়েছে। গতকাল বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন লালমনিরহাটের ছাত্র প্রতিনিধি তাহ হিয়াতুল হাবীব মৃদুল থানায় অভিযোগ দেন। এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে সাংবাদিকদের জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্র : সমকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ জাতীয় আরো খবর..

ফেসবুকে আমরা