নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি::হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর ইউনিয়নে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে জনতার বাজারে অবৈধভাবে বসানো পশুর হাটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে হেনস্তা, তর্ক ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ২০০ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঘটনার পর এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ধরে এই হাট পরিচালনা করে আসছে একটি প্রভাবশালী চক্র, যারা প্রতি হাটে লাখ লাখ টাকা আদায় করলেও কোনো সরকারি রাজস্ব প্রদান করে না।
গত শনিবার (৩১ মে) জনতার বাজার পশুর হাটে হাইকোর্টের নির্দেশনা ও জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হাট বসানো হয়। খবর পেয়ে হাট পরিদর্শনে যান উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি)। সেখানে হাট কমিটির একদল স্বেচ্ছাসেবক প্রশাসনের কাজে বাধা দেয় এবং তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ধাক্কাধাক্কির মতো ঘটনাও ঘটে।
পরদিন রবিবার (১ জুন) নবীগঞ্জ উপজেলার গোপলার বাজার (ভূমি) কর্মকর্তা সত্যেন্দ্র দেবনাথ বাদী হয়ে নবীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। এতে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২০০ জনকে আসামি করা হয়।
জনতার বাজার হাটটি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার কেন্দ্রে। স্থানীয় প্রশাসনের একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাজনৈতিক মদদে হাটটি চালু রাখা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক মাসে একাধিকবার লিখিত নিষেধাজ্ঞা ও মাইকিং করেও হাট বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, প্রতি হাটে গড়ে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা ‘প্রত্যয়ন ফি’ আদায় করা হয়, যার কোনো সরকারি অনুমোদন নেই। হাট কমিটির পক্ষ থেকে এসব অর্থের কোনো বৈধ রসিদও দেওয়া হয় না। এই অর্থের বড় অংশ কোনো নিরীক্ষা ছাড়াই ‘হাট পরিচালনা খরচ ও মসজিদ ফান্ডে ব্যয় দেখানো হয়।
হাট পরিচালনা কমিটিতে থাকা ব্যক্তিদের পরিচয়ও জনমনে প্রশ্ন তুলেছে। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। অনেকে বলছেন, রাজনৈতিক বিভাজন থাকা সত্ত্বেও কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্যের জন্য সবাই এক কাতারে।
এ বিষয়ে জনতার বাজার পশুর হাট পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী তোফায়েল আহমদ বলেন, “আমরা হাইকোর্টের রুলনিশি অনুযায়ী হাট পরিচালনা করছি। প্রত্যয়ন ফি মূলত হাটের খরচ ও এলাকার মসজিদ ফান্ডে দেওয়া হয়।”
তবে জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হাটটি কোনোভাবেই বৈধ নয় এবং এই নামে জেলা প্রশাসনের কোনো অনুমোদিত পশুর হাট নেই।
নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন বলেন, “এই হাট থেকে জানুয়ারি মাস থেকে কোনো সরকারি রাজস্ব আদায় হয়নি। অবৈধভাবে টাকা তুলে কিছু লোক নিজেরা পরিচালনা করছে। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করার কারণে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান জানান, “৩৮ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি। তদন্ত চলছে, আসামিদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসন ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কীভাবে এই হাট চালু থাকে—এই প্রশ্নের উত্তর তারা খুঁজে পান না। কারা এই অবৈধ বাণিজ্যের পেছনে আছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কেন রক্ষা পায়-এ নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “আমরা সাধারণ মানুষ এক হাজার টাকা দেনা থাকলেও জবাব দিতে হয়। কিন্তু যারা কোটি টাকা অবৈধভাবে তুলছে, তারা ঠিকই বুক ফুলিয়ে ঘুরছে।”
জনতার বাজার পশুর হাট নিয়ে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে। এখন দেখার বিষয়, সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই অবৈধ হাট ও এর পেছনের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
Leave a Reply