বিবিয়ানা নদী ও ইনাতগঞ্জ বাজার: একটি ইতিহাসের গল্প

ডেস্ক রিপোর্ট::হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ইনাতগঞ্জ বাজারের শেকড় গড়ে উঠেছে ১৬৫৬ সালে। এই বাজারের প্রতিষ্ঠাতা হাজী এনায়েত উল্লা খাঁন, যিনি স্থানীয় মানুষের সুবিধার্থে বিবিয়ানা নদীর পাড়ে একটি মাত্র দোকান দিয়ে এর সূচনা করেন। তার দূরদর্শিতা ও সমাজসেবামূলক উদ্যোগের ফলেই এলাকাবাসীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এই বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি “এনায়েতগঞ্জ বাজার” নামে পরিচিতি লাভ করে, যা সময়ের বিবর্তনে হয়ে যায় “ইনাতগঞ্জ বাজার”। এই নামটি এখন স্থানীয় মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে। বাজারটি শুধুমাত্র একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়, এটি এলাকার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
বর্তমানে ইনাতগঞ্জ বাজার স্থানীয় ও আশপাশের এলাকার মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। হাজী এনায়েত উল্লা খাঁনের অবদান ও নেতৃত্ব আজও মানুষের মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে। তার প্রতিষ্ঠিত এই বাজার এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।
ইনাতগঞ্জ বাজার শুধুমাত্র একটি বাজার নয়; এটি একটি ঐতিহ্যের প্রতীক, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের কাছে ইতিহাসের গল্প বলে যাবে।
ইনাতগঞ্জ বাজারের ইতিহাস জড়িয়ে আছে বিবিয়ানা নদীর গল্পের সাথে। এই নদী ছিল একসময় ইনাতগঞ্জ অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র। তখন মানুষ প্রকৃতির সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিল, আর বিবিয়ানা নদী তাদের জীবনের সবকিছু। কালের বিবর্তনে এই নদী যেমন তার রূপ হারিয়েছে, তেমনি গড়ে উঠেছে আধুনিক ইনাতগঞ্জ।
বিবিয়ানা নদী ছিল একসময় অপ্রতিরোধ্য। বর্ষাকালে এর জলস্রোত ছিল প্রবল, আর শুষ্ক মৌসুমেও এটি ছিল প্রাণচঞ্চল। নদীর বুকে পালতোলা নৌকা, জাহাজ, মাঝিদের গান—সব মিলিয়ে নদীর পাড় ছিল কর্মব্যস্ত। স্থানীয় কৃষকরা তাদের ফসল নিয়ে আসত নদীর পাড়ে। সেখান থেকে পণ্য যেত দূর-দূরান্তে। নদীটি ছিল বাণিজ্যের সেতুবন্ধন।
বিবিয়ানার স্রোতধারায় শুধু পণ্য পরিবহনই নয়, মানুষের জীবনও ছিল সরব। উৎসব, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, এবং সামাজিক মিলনমেলার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই নদীর তীর। এটি শুধু প্রাকৃতিক জলপথ নয়; এটি ছিল একটি সভ্যতার মূল সঞ্চালক।
তাছাড়া বিবিয়ানা নদীটি একসময় ইনাতগঞ্জ ঘাটের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যম ছিল। এই ঘাট থেকে জাহাজে লোকজন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতেন। বিশেষ করে, অনেকে সৌদি আরব গিয়েছেন পবিত্র হজ্ব পালন করার জন্য। এ থেকেই বোঝা যায়, তখনকার সময়ে এই নদী ও ঘাটটি কেবল আঞ্চলিক নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগের একটি কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এটি ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিবিয়ানা নদী তার রূপ বদলাতে থাকে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পলি জমে যাওয়া, এবং পরিবেশ দূষণের ফলে নদীটি তার প্রাণশক্তি হারায়। একসময় যে নদী ছিল গহীন আর স্রোতস্বিনী, তা আজ সংকীর্ণ ও প্রায় শুষ্ক। নদীর বুক জুড়ে গড়ে ওঠা ছোট ছোট চর তার প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে। জাহাজের বাঁশি, নৌকার কোলাহল আর শোনা যায় না।
অন্যদিকে, নদীর পরিবর্তনের মধ্যেই ইনাতগঞ্জ বাজার ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। একসময়কার ছোট্ট হাটটি আজ একটি আধুনিক শহর। বাজারটি এখন শুধু স্থানীয়দের জন্য নয়, বরং আশপাশের অঞ্চলের মানুষদের জন্যও কেনাকাটার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। নতুন দালানকোঠা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইনাতগঞ্জকে একটি শহুরে এলাকায় পরিণত করেছে।
তবে এই পরিবর্তন সুখকর হলেও বিবিয়ানা নদীর হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি আজও মানুষের মনে গভীর দাগ কেটে যায়। প্রকৃতির সাথে মানুষের এই বিচ্ছিন্নতা ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কবার্তা। বিবিয়ানার গল্প আমাদের শিখিয়ে দেয় প্রকৃতিকে অবহেলা করলে তার মূল্য চুকাতে হয়।
আজকের ইনাতগঞ্জ শহর আমাদের উন্নয়নের প্রতীক হলেও, বিবিয়ানা নদী আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই প্রকৃতির রূপ, যা একসময় আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছিল। এটাই আমাদের দায়িত্ব, যেন আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এমন কোনো দুঃখগাঁথা রেখে না যাই।
ইনাতগঞ্জ বাজার ও বিবিয়ানা নদীর গল্প কেবল একটি জনপদের বিবর্তনের নয়; এটি সময়, প্রকৃতি, এবং মানুষের সম্পর্কের এক অনবদ্য অধ্যায়। ইতিহাসের এই শিক্ষা আমাদের পথ দেখাবে, যেন আমরা উন্নয়ন ও প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে এগিয়ে যেতে পারি। বিবিয়ানা আর ফিরে আসবে না, কিন্তু তার গল্প থাকবে অনন্তকাল ধরে, আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে যে প্রকৃতি আর মানুষের জীবনের মাঝে সংযোগ অটুট রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
……..
….

ইনাতগঞ্জ একসময় পাটের জন্য বিখ্যাত ছিল, এখানকার পাট বিদেশে রপ্তানি হতো। পাটশিল্পের এই গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরতে নিউজটি আপনার কাছে আনবো কিনা, তা জানাতে কমেন্ট করুন। পাটের ঐতিহ্য জানতে চোখ রাখুন আমাদের আপডেটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ জাতীয় আরো খবর..

ফেসবুকে আমরা