মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া, লন্ডন : বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ব্রিটেনের ভিসা প্রাপ্তির হার গত কয়েক মাস ধরে অন্তত আশি শতাংশ। অক্টোবরের ৫ তারিখ থেকে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য নতুন পয়েন্ট ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে। আর ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ব্রিটেনের ওয়ার্ক পারমিট ভিসার ক্ষেত্রেও শর্ত শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। এর ফলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও কর্মীদের ব্রিটেনে পড়াশোনা ও কাজের সুযোগ পুনরায় উন্মুক্ত হতে চলেছে।
২০২০ সালের টায়ার-ফোর স্টুডেন্ট’ ভিসায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে যেটি ৪০ পয়েন্ট ছিল এখন তা ৭০ পয়েন্ট করা হয়েছে। কনফার্মেশন অব অ্যাকসেপট্যান্স স্টাডিজ (সিএএস) পেপারে ৫০ পয়েন্ট, ১০ পয়েন্ট ল্যাংগুয়েজে এবং ১০ পয়েন্ট ব্যাংক সলভেন্সির জন্য। ২০২০ সালের অক্টোবরের ৫ তারিখের পর যারা ব্রিটেনে আসবেন তাদের জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় ছাড়া কোনও শিক্ষার্থী আসতে পারছেন না। কাজের সময়সীমা সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা। স্টুডেন্টদের ডিপেন্ডেন্টদের ক্ষেত্রে এখন ফুলটাইম কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছে নতুন নীতিতে। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী লেখাপড়া শেষ করার পর ২ বছর ও ডক্টরেট বা পিএইচডি পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী ৩ বছর ফুল টাইম কাজের সুযোগ পাবেন।
করোনাকালেও বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী ব্রিটেনে এসেছেন। সিলেটের বাসিন্দা রেজওয়ান আহমেদ বৃহস্পতিবার স্টুডেন্ট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে এসেছেন। কোয়ারেন্টিনে থাকা এই শিক্ষার্থী বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় করোনাকালে ব্রিটেনের সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন শর্ত শিথিল করায় এ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ব্রিটেনে আসছেন।
এদিকে, ওয়ার্ক পারমিট ভিসার ক্ষেত্রেও আগামী জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন শর্ত শিথিল করা হয়েছে। দক্ষ শ্রমিক (স্কিল ওয়ার্কার) রুটে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘লেভেল সিক্স’র শর্তাবলি পূরণের যোগ্যতা চাওয়া হলেও জানুয়ারি থেকে তা ‘লেভেল থ্রি’তে নামিয়ে আনা হবে। ব্রিটিশ সরকারের ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজারি কমিটি (ম্যাক) কর্মী স্বল্পতা থাকা পেশার তালিকায় (শর্টেজ অকুপেশন লিস্টে) নতুন করে ৭০টি পেশার প্রস্তাব করেছে। এতে নতুন করে বহু পেশার মানুষের পক্ষে ব্রিটেনে আসার পথ সুগম হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শর্টেজ অকুপেশন লিস্টে ক্যাটারিং ম্যানেজার, কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার থেকে শুরু করে নির্মাণ বা বেকারি কর্মী, কেয়ারারসহ বহু পেশার মানুষের ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় ব্রিটেনে আসার পথ সুগম হবে। এছাড়া ওয়ার্ক পারমিটে যারা আসবেন তারা পাঁচ বছর পর ব্রিটেনে স্থায়ী বসবাসের জন্য ‘ইনডেফিনিট লিড টুরিমেইনের ক্ষেত্রেও সমান বেতন কাঠামোয় আবেদন করতে পারবেন।
ব্রিটেন থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান জনশক্তি আনতে চাইবে তাদের হোম অফিসে নিবন্ধিত হতে হবে। ব্রিটিশ হোম অফিসের সঙ্গে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম।
ব্রিটেনে এখন করোনার কারণে লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সেখানে নতুনদের কাজের সুযোগ করে নেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্রিটেনে আসতে আগ্রহীদের জন্য সতর্কতা:
ব্রিটেনে অভিবাসন বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা অভিজ্ঞজনরা বলছেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে স্টুডেন্ট বা ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। এর মূল কারণ ছিল উচ্চ টিউশন ফি, স্টুডেন্ট ভিসায় কলেজ পর্যায়ে কাজের সুযোগ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসা।
অন্যদিকে, ওয়ার্ক পারমিটের ক্ষেত্রেও ২০০৩ বা তার পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনে আসা বাংলাদেশিদের প্রায় ৭০ শতাংশই প্রতারণার শিকার হন। একই ওয়ার্ক পারমিট একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি, ওয়ার্ক পারমিটদাতা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া, কর্মীকে প্রতিশ্রুত বেতন না দেওয়া, ভিসায় উল্লেখ থাকা কাজে নিয়োগ না দিয়ে অন্য কাজে বাধ্য করা, ভিসা বৈধ রাখতে ট্যাক্সের অর্থসহ বিভিন্ন অর্থ কর্মীর কাছ থেকে আদায় করার ঘটনা ঘটে। আর স্টুডেন্ট ভিসার ক্ষেত্রে ভিসা পাওয়া শিক্ষার্থীরা লন্ডনে এসে জানতে পারেন টাকা জমা দেওয়া হয়নি।
এছাড়া স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রে সেশনের টিউশন ফি পুরোটা পরিশোধিত লেখা থাকলেও শিক্ষার্থী লন্ডনে আসার পর দেখতে পান কোনও টাকাই কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়নি। তবে এখন এ ধরনের প্রতারণার সুযোগ কমেছে। আগে কলেজগুলোর নামে এজেন্টদের তৈরি এক্সটেনশন লেটারের মাধ্যমে প্রতারণা হতো। ভুয়া কলেজগুলো ইউকেবিএ বন্ধ করেছে। ২০১৩ সালে এসব বন্ধ করেছে সরকার। এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় ছাড়া কোনও শিক্ষার্থী আসতে পারছেন না।
গজিয়ে উঠছে অসংখ্য কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান:
ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়কে সামনে রেখে ব্রিটেনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের স্টুডেন্ট ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট ভিসার কনসালটেন্সির জন্য পূর্ব লন্ডনে এরই মধ্যে গজিয়ে উঠেছে নতুন নতুন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। ঢাকাসহ প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট, মৌলভীবাজারে রীতিমতো পোস্টার-লিফলেট বিলি করে শুরু হয়েছে ব্রিটেনের স্টুডেন্ট ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট ভিসার প্রসেসিং ব্যবসা। অনলাইনেও চলছে চটকদার প্রচার।
এ ব্যাপারে স্টুডেন্ট বা ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় আগ্রহীদের বিস্তারিত জেনে-বুঝে আগাতে হবে।
অতীতের পরিসংখ্যান আর এখনকার বাস্তবতায় যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তা হলো, অর্থনীতি যখনই তুলনামূলক খারাপ অবস্থায় পড়ে তখনই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশগুলো থেকে স্টুডেন্ট বা ওয়ার্ক পারমিটে মানুষ আসার পথ খুলে দেয় ব্রিটেন। এতে সরকার বিভিন্ন ফির মাধ্যমে সরাসরি লাভবান হয়। দ্বিতীয়ত, তৃতীয় সারির কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এটি সরকারের একটি কৌশল। যারা আসতে চান তাদের বিষয়টি মাথায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
Leave a Reply