হাবিবুর রহমান খান,মৌলভীবাজার::মৌলভীবাজারের বড়লেখায় গত রোববার পরিবহন শ্রমিকদের আটকানো অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর মারা যায় সাত দিন বয়সী শিশুকন্যা খাদেজা বেগম। শিশুটির বাড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের অজমীর গ্রামে। মেয়ের জামা হাতে নিয়ে নির্বাক তাঁরা। সাত দিন বয়সী শিশুকন্যা খাদেজা বেগমের জামা হাতে নিয়ে বিলাপ করছিলেন তার মা সায়রা বেগম। পাশে বসা বাবা দুবাইপ্রবাসী কুটন মিয়া শোকে নির্বাক। প্রতিবেশীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মায়ের বিলাপ থামছেই না। সোমবার বিকেলে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সদর ইউনিয়নের অজমীর গ্রামে কুটন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়।
অসুস্থ মেয়ে খাদেজাকে গত রোববার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে পরিবহন শ্রমিকদের বাধায় আটকা পড়ে অ্যাম্বুলেন্সটি। দেড় ঘণ্টা সেখানে আটকে থাকার একপর্যায়ে মায়ের কোলে নিথর হয়ে পড়ে সে। দ্রুত নিকটবর্তী বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কুটন মিয়া গতকাল বলেন, তাঁদের পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে। খাদেজা সপ্তম সন্তান ছিল। ২২ অক্টোবর তার জন্ম হয়েছিল। এর আগের দিন ২১ অক্টোবর তিনি ছুটি পেয়ে দুবাই থেকে দেশে ফেরেন।
কুটন বলেন, গত শনিবার রাত থেকে খাদেজা খেতে পারছিল না। শুধু কান্নাকাটি করছিল। এ কারণে রোববার সকালেই তাঁরা শিশুটিকে বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানকার চিকিৎসকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দ্রুত তাকে সিলেটে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতি কর্মসূচির কারণে বিপাকে পড়েন। পরে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেন। প্রথমে বড়লেখার দরগাহ বাজার এলাকায় অ্যাম্বুলেন্সটি পরিবহন শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ে।
প্রায় ১৫ মিনিট আটকে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর দাসের বাজার এলাকায় আটকানো হয়। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে চান্দগ্রাম বাজারে পৌঁছালে পরিবহন শ্রমিকেরা আরেক দফা অ্যাম্বুলেন্সটি আটকান। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা অ্যাম্বুলেন্সের চালককে নামিয়ে চড়-থাপ্পড় মারেন। সেখানেও প্রায় আধা ঘণ্টা আটকা পড়ে থাকেন। এরই মধ্যে শিশুটি নিথর হয়ে পড়ে। পরিবহন শ্রমিকেরা শিশুটির এ অবস্থা দেখে অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দেন। পরে নিকটবর্তী বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।
শিশুটির মা সায়রা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। অ্যাম্বুলেন্সের জানালা খুলিয়া লোকেরা (পরিবহনশ্রমিক) বারবার বাইচ্চাটারে দেখছিলেন। কেউ কেউ বাইচ্চা আছা না মিছা অসুস্থ্ এই সব কথাও বলছিলেন। মানুষ অইয়াও তাঁরা বাইচ্চাটার কষ্ট বুঝল না। বাইচ্চাটা আমার কোলেই জনমর ঘুম (চিরনিদ্রা) দিল।’
শিশুটির চাচা আকবর আলী বলেন, রোববার বাদ মাগরিব শিশুটিকে দাফন করা হয়েছে। ঘটনার খবর পেয়ে রোববার রাতে বড়লেখা থানার পুলিশ, বড়লেখা পৌরসভার মেয়র আবুল ইমাম মো. কামরান চৌধুরী, বড়লেখা সদর ইউপির চেয়ারম্যান শোয়েব আহমদ তাঁদের বাড়িতে আসেন। তাঁরা এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হবে।
অ্যাম্বুলেন্সের চালক সদর ইউনিয়নের মুছেগুল গ্রামের বাসিন্দা শিপন আহমদ মুঠোফোনে বলেন, অ্যাম্বুলেন্স হরতাল-অবরোধের আওতার বাইরে থাকে। এটা সবাই জানে। কিন্তু রোববারের ঘটনায় তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন।
বড়লেখা উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আহমদ হোসেন বলেন, শিশুটি ‘সেপটিসেমিয়া’ ও ‘নিওনেটাল জন্ডিস’ রোগে আক্রান্ত ছিল। দুটিই গুরুতর রোগ। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিলেটে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
বড়লেখা থানার ওসি ইয়াছিনুল হক সোমবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে বলেন, তাঁরা ঘটনাটি শুনেছেন। এ ব্যাপারে ওই শিশুর পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বড়লেখা উপজেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স আটকানোর কথা নয়। চান্দগ্রাম এলাকায় লাইটেসের (মাইক্রোবাস) কিছু শ্রমিক দুই-চারটা গাড়ি আটকেছিলেন। এর পেছনে নাকি অ্যাম্বুলেন্সটা ছিল। পরে অবশ্য অ্যাম্বুলেন্সটা তাঁরা ছেড়ে দেন।’
তবে উপজেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান দাবি করেন, চান্দগ্রামে তাঁদের সংগঠনের শ্রমিকেরা কোনো অ্যাম্বুলেন্স আটকাননি। চালককেও মারধর করা হয়নি।
Leave a Reply