সিয়াম সাধনার পর বাঁকা চাঁদ দেখেই ঈদুল ফিতর

নজরুল ইসলাম তোফা:: সারা বিশ্বের মুসলমানদের ধর্মীয় এবং জাতীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এই দিনটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ এবং মহিমায় অনন্য। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার শেষেই শাওয়ালের ‘বাঁকা চাঁদ’ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদ। “আউদ” মূলশব্দ থেকেই আরবী শব্দটি ”ঈদ” অর্থাৎ এ ঈদের প্রমিত বাংলা শব্দ হচ্ছে আনন্দ, খুশি বা আনন্দোৎসব। যা ফিরে ফিরে এসেই অনুষ্ঠিত হয় বাঙালির ঘরে ঘরে ঈদ। এইটি ইসলাম ধর্মের রীতি হিসেবে গণ্য। ফিতর শব্দের অর্থ হচ্ছে রোজা ভাঙা বা খাওয়া। আসলেই ঈদুল ফিতরে ১ মাস রোজা থেকে আত্ম সুদ্ধি হয়।সেই আত্ম সুদ্ধির কাঠামোকেই ভেঙ্গে ফেলার চরম আনন্দ উৎসবকে “ঈদুল ফিতর” বলা যেতে পারে।সুতরাং “ঈদুল ফিতর” সারা বিশ্বের মমিন মুসলমান ধর্মাবলম্বীর দুটি ঈদের মধ্যে একটি ঈদ। ঈদ খুশির অন্যতম প্রধান উপকরণ হচ্ছে ঈদের দিনে ঈদগাহে দুই রাকায়াত ওয়াজিব নামাজ পড়া। এমন এঈদের নামাজের ফজিলত সম্পর্কেই মহানবী বলেন, ঈদুল ফিতরের এই দিনে ‘ফেরেশ্তারা’ রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে বলে থাকেন:– হে মুসলিম! নেককাজের ক্ষমতাদাতা এবং সাওয়াবের আধিক্য দাতা, আল্লাহ’র কাছে অতি শিগগির চলো। কারণ, তোমাদেরকে রাতে ইবাদতের হুকুম করা হয়েছিল, তোমরাই তো তা পালন করেছ, দিনে রোজা রাখার নির্দেশ করা হয়েছিল, অবশ্যই তোমরা তা যথাযথই করেছ। গরিব দুঃখিকে “আহার দান” করেছ, আজ তারই পুরস্কার গ্রহণ কর। তারপর মমিন মুসলমান যখন এমন ঈদের নামাজ পড়ে তখন এক ফেরেশ্তা উচ্চ স্বরে ঘোষণা করেন, তোমাদেরকে তোমাদেরই সৃষ্টিকর্তা দয়ালু প্রভু ভালোবাসার সহিত ক্ষমা করে দিয়েছেন। এখন তোমরাই পুণ্যময় দেহ ও মন নিয়ে তোমাদের ঘরে ফিরে যাও। সুতরাং এমন এদিনটির এতো গুরুত্ব বা ফজিলত আছে, সে হেতু মহান সৃষ্টি কর্তার উপহারের দিন হিসেবেই গণ্য করেন। সুতরাং ঈদুল ফিতরের এমন এ তথ্য গুলোর সন্ধান পাওয়া যায় তাবরানী শরীফের হাদিসে।

আসলেই মুসলিম উম্মার এই “ঈদ” প্রতি বছর চান্দ্র বর্ষ পঞ্জি অনুযায়ী রমজান মাসের নির্দিষ্ট তারিখেই নির্দিষ্ট রীতিতে এক অনন্য আনন্দ-বৈভব বিলাতেই যেন ফিরে আসে। এক মাস কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নানা নিয়ম কানুন পালনের পরেই ফুর ফুরে মেজাজে উদ্যাপিত হয় ঈদুল ফিতর কিংবা রোজার ঈদ। গোটা রমজান মাস রোজা রেখে আল্লাহ ভীরু মানুষ তাঁর ভেতরের সব বদভ্যাস ও খেয়াল খুশিকে দমন করে এক রকমের বিজয় অর্জন করে। সকল দিক বিশ্লেষণেই ঈদুল ফিতরকে বিজয় উৎসব বলা যেতে পারে। আসলেই বলা যায় যে, ঈদুল ফিতরের প্রত্যেকটি অনুশাসনে ইবাদতের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তাছাড়া এদিনে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সত্যনিষ্ঠ জীবন এবং বলা যায় মানবতার বিজয়বার্তা। তবে প্রচলিত নিয়মে দীর্ঘ এক মাস রোজা রেখে আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেই দিনটিকে স্মরণীয় করার নাম ঈদ উৎসব।ঈদ আসলেই সাম্যের বাণী নিয়ে আসে। এদিন ধনী, গরীব, ছোট ও বড় সকলেই যেন কোনো ভেদাভেদ রাখে না। আল্লাহর দেওয়া এমন খুশিতে মেতে ওঠে সবাই। তাই এ দিন আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং গরীব-দুখীদেরকে স্মরণ করেই তাদের সাহিত মিলেমিশেই খুশি বন্টন করা উচিৎ। আবার বলতেই হয়, ঈদ কেবল একটি খুশির বা আনন্দ উদ্যাপনের দিন নয়। ঈদ একটি ইবাদতের নাম। এমন এ দিনটি আমলের জন্যই এক বিরাট নেয়ামত বৈকি। সুতরাং এইদিনে বিশেষ কিছু ইবাদত কিংবা আমল রয়েছে, যাতে অনেক ‘পুণ্য লাভ’ হয়। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, যে ব্যক্তি ৫ টি রাত জেগে ইবাদত করবে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। সেই রাত গুলো হলো-‘জিলহজের রাত’, ‘আরাফার রাত’, ‘ঈদুল আজহার রাত’, ‘মধ্য শাবানের রাত’ বা ‘ঈদুল ফিতরের রাত’।সুতরাং ঈদুল ফিতরের রাতেই ঈবাদত করা অনেক পুণ্যময় ও খুবই তাৎপর্য পূর্ণ কাজ।

ঈদের স্বরূপ এবং তাৎপর্য বোঝার জন্য আল্লাহ তা আলা বলেছেন যে, রমযান মাসেই কুরআন নাযিল হয়, যা মানুষের জন্য হিদায়াত, সৎপথপ্রাপ্তির স্পষ্ট নিদর্শন এবং হক্ব-বাতিলের মধ্যেই তা পার্থক্যকারী। কাজেই তোমাদের যে কেউ এই মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই এর রোযা রাখে। কেউ পীড়িত হলে কিংবা সফরে থাকলে, তাকে অন্য সময়েই এ রোযা সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য সহজসাধ্যতা চান, আসলেই কারও প্রতি কঠোরতা আরোপ করতে চান না এবং এই জন্যই যে, তোমরা সংখ্যা পূরণ করবে ও যাতে তোমরা আল্লাহর মহিমা বর্ণনা কর। তিনি তোমাদেরকে হিদায়াত করেছেন। আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।’-সূরা বাকারা : ১৮৫ অতএব, রোজাদারের যে পরিচ্ছন্নতা বা পবিত্রতার সৌকর্যের দ্বারা আত্ম শুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার অজস্র গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতি ধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার শপথ গ্রহণেই “ঈদুল ফিতর” সমাগত হয় মমিন মুসলমানদের ঘরে ঘরে। তাই এ দিন যেন আনন্দধারা প্রবাহিত হয়। ঈদের দিনেই ধনী-গরিব কিংবা মালিক-শ্রমিকনির্বিশেষে সকল মুসলমানগণ এক কাতারেই মিলেমিশে ঈদের কোলাকুলি অথবা সাম্যের জয়ধ্বনি করে। তাদের মহামিলনেই পার্থিব সুখ-শান্তি, স্বস্তি কিংবা পারলৌকিক মুক্তি কামনায় আল্লাহর দরবারে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

আরবী শাওয়াল মাসের এক তারিখেই ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। ফলে এর আগের মাস তথা রমজান মাসের বিদায়ে নিশ্চিত হলেই ঈদুল ফিতরের দিনটি নিশ্চিত হয়ে যায়। আবার আরবী মাস যেহেতু চান্দ্র মাস, তাই চাঁদ দেখার ওপরেই ঈদের আগমনী বার্তা নির্ভর করে। তাই তো ”নতুন চাঁদ” দেখা মাত্র রেডিও টেলিভিশন এবং পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকেই ঘোষিত হয় খুশির বার্তা—‘ঈদ মোবারক’। সেই সঙ্গে চারদিকে শোনা যায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত জনপ্রিয় রোজার ঈদের গান–
ও মন, রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশীর ঈদ/
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে,
শোন আসমানী তাগিদ।

লেখক:
নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ জাতীয় আরো খবর..

ফেসবুকে আমরা