হবিগঞ্জ প্রতিনিধি ॥ হবিগঞ্জ জালাল স্টেডিয়াম জেলা প্রশাসন আয়োজিত লোক উৎসবের ১ম দিনে শিল্পীদের গানে গানে উল্লাসে মেতে উঠেছেন হাজারো দর্শক। শিল্পীরা মরমি সাধক মুন্সি শাহ জহির উদ্দিন দীনহীন, রাধা রমন, হাছন রাজাসহ বিভিন্ন গীতিকবির রচিত প্রখ্যাত গানগুলো পরিবেশন করেছেন। এছাড়াও কুষ্টিয়ার লালন একাডেমীর একদল শিল্পী লালন সাইর জনপ্রিয় গানগুলো পরিবেশন করে মাতিয়ে তুলেন দর্শকদের। গতকাল বিকেলে আলোচনা সভা শেষে স্থানীয় শিল্পীরা বাউল গান পরিবেশন করেন। স্থানীয় শিল্পীদের গান পরিবেশন শেষ হওয়ার পরই মঞ্চে উঠেন কুষ্টিয়ার লালন একাডেমীর একদল শিল্পী। এরপর বাউল সিরাজ, রাখি শবনম, শিরিন সুলতানা, শিরিন আক্তার লালনের ৪টি গান পরিবেশন করেন। লালনের গান আর বাজনার শব্দে উপস্থিত দর্শকরা মুখরিত হয়ে উঠেন। তারপর মঞ্চে উঠেন ক্লোজআপ ওয়ান খ্যাত জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী লায়লা। তিনি ২টি বাউল গান পরিবেশনের পর দর্শকরা তোমার জন্য পাঙ্খা হলো, পাঙ্খা হলো মন গান পরিবেশন করার অনুরোধ করলে শিল্পী লায়লা পাঙ্খা গানটি পরিবেশন করেন। এ সময় দর্শকরাও শিল্পীর সাথে পাঙ্খা পাঙ্খা হলো মন গানটি গেয়ে উল্লাস করেন। লায়লার গানের পরেই গান পরিবেশন করতে মঞ্চে উঠেন হবিগঞ্জের সৈয়দ আশিকুর রহমান আশিক (বাউলা আশিক)। এ সময় আশিক বলেন- তার বাবা ৪দিন হলো মারা গেছেন। বাবা মারা যাওয়ায় এই মুহূর্তে তার গান গাওয়ার কথা ছিল না। শুধু হবিগঞ্জের মানুষের ভালবাসার টানে গান গাইতে মঞ্চে উঠেছেন। তবে অন্য দিন থেকে তিনি খুব কম গান পরিবেশন করবেন বলে জানান। কন্ঠশিল্পী আশিক যখন কথা বলছিলেন তখন তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। এ অবস্থায় গানের আনন্দের মধ্যেই উপস্থিত দর্শকরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। পরে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদের বাবার নামে লেখা একটি অপ্রকাশিত গানের প্রথম দুটি কলি গেয়ে শোনান আশিক। এরপর তিনি উকিল মুন্সীর লেখা সোয়া চাঁন পাখি আমি ডাকছি, তুমি পাখি ঘুমাইছ নাকি গানটি পরিবেশন করেন। আশিকের আবেগময় এই গানটি পরিবেশনকালে দর্শকরা নিস্তব্ধ হয়ে পড়েন। আশিকের ওই গান শেষ হওয়ার পরই জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী চিশতী বাউল মঞ্চে উঠেন। মূলত লোক উৎসবের ১ম দিনের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিলেন চিশতী বাউল। বয়স হলেও চিশতী বাউলের কণ্ঠ সুমধুর। সম্প্রতি তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাকে বিভিন্ন স্থানে হুইল চেয়ারের উপর নির্ভর হয়ে গানের অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে। ইদানিং কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তিনি হবিগঞ্জে ছুটে আসেন। জালাল স্টেডিয়ামে ঢুকার পর দর্শকরা তার সাথে ছবি তোলার জন্য ভিড় জমান। এ সময় দর্শকদের সামাল দিতে পুলিশ অনেকটা হিমশিম খায়।
মঞ্চে কখন চিশতী বাউল উঠবেন অপেক্ষা করেছিলেন দর্শকরা। কখন তিনি মঞ্চে উঠে শুনাবেন আলোচিত সেই গান ‘যদি থাকে নছিবে আপনা-আপনি আসিবে।’ চিশতী বাউল যখন মঞ্চে উঠে শোনালেন তার জনপ্রিয় গান বেহায়া মনটা লড়া তোমারে ভালবাসিয়া আজ আমার ঘটিল জঞ্জাল। পরে তিনি বেহায়া মন-২ গানটি শোনান। তারপর বিরতি নেন। এর মধ্যে শিল্পী সেলিম চৌধুরী মঞ্চে উঠে মরমি সাধক মুন্সি শাহ জহির উদ্দিন দীনহীনের আজ পাশা খেলবো রেম শাম, বৃষ্টি পড়ে টাপুর, টুপুর ও হাছন রাজার বিখ্যাত গান কি ঘর বানাইমু আমি শুন্যেরও মাজার। লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ি বালা না আমার। বালা কইরা ঘর বানাইয়া থাকমু কত কাল। সেলিম চৌধুরীর গান পরিবেশনের পালা শেষ হওয়ার পরই মঞ্চে আবার উঠেন চিশতি বাউল। তিনি যদি থাকে নছিবে, আপনা আপনি আসিবে গানটি শুনিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে তুলেন। এর মধ্য দিয়ে লোক উৎসবের ১ম দিনের সমাপনী ঘটে। লোক উৎসবের গান দর্শকদের সামনের সারিতে বসে উপভোগ করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী এমপি, হবিগঞ্জ-২ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান, জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যাসহ সরকারি, কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজন।
উল্লেখ্য, জেলা প্রশাসন আয়োজিত এ লোক উৎসবের প্রতিপাদ্য ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাতি গঠনে লোক সংস্কৃতি চর্চার ভূমিকা’। প্রাণ গ্রুপের সৌজন্যে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে দেশবরেণ্য বাউল শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন দেশের জনপ্রিয় শিল্পী সামছুল হক চিশতী বাউল, সেলিম চৌধুরী, লায়লা, বাউলা আশিক, সিরাজ উদ্দিন, কুষ্টিয়ার লালন একাডেমীর রাখি শবনম, শিরিন সুলতানা, শিরিন আক্তার, শামীম আহমেদসহ স্থানীয় শিল্পী আকরাম আলী, জালালী সালমা, ভাবনা সরকার, রাজীব প্রমূখ। উৎসব চলবে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রথম দিনের এ উৎসব মরমি সাধক মুন্সি শাহ জহির উদ্দিন দীনহীনের নামে উৎসর্গ করা হয়।
Leave a Reply