নবীগঞ্জ প্রতিনিধি : নবীগঞ্জের ইনাতগঞ্জের নীলু সূত্র ধর হত্যাকান্ডের ঘটনায় আদালতে চার্জশীট দাখিল করেছে পুলিশ। মামলার বাদী নিহত নীলু সূত্রে ধরের মেয়ে শিল্পি সূত্র ধরের অভিযোগ চার্জশীটে মূল ঘটনা উন্মোচিত হয়নি। তিনি দাখিলকৃত চার্জশীটের বিরুদ্ধে নারাজী দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। এদিকে মামলার চার্জশীটে অন্তর্ভক্ত ৫জন সাক্ষি আদালতে এফিডেভিট দিয়েছেন। সাক্ষিদের অভিযোগ চার্জশীটে পুলিশ যে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এ বিষয়ে তাদের কোন কিছু জানা নাই।
জানা যায়,নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের ইছবপুর গ্রামের মৃত চানমনি সূত্র ধরের স্ত্রী নীলু সূত্র ধর। স্বামীর মূত্যুর পর তিনি ৪ মেয়ে ১ ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। কোন রকম খেয়ে না খেয়ে অভাব অন্টনের মধ্য থেকেও সন্তানদের বড় করেন। দারিদ্রতা তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি ছিলেন সদালাপী। গ্রামের মানুষের কাছে ও প্রিয় ছিলেন। ইনাতগঞ্জ বাজারের পাশে তার গ্রামটি হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীরা ও তাকে চিনতেন। একজন ভাল বৃদ্ধা মহিলাকে এভাবে ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হবে কেউ কল্পনা ও করেনি।
নিহত নীলু সূত্র ধরের একমাত্র সন্তান জীবন সূত্র ধরের বয়স যখন ১২/১৩ বছর তখনই তিনি সংসারের হাল ধরেন। মা বোনদের সুখে রাখতে শিশু বয়সেই কাঠমিস্ত্রি কাজ শুরু করেন।
এর কয়েক বছর পর জীবন সূত্র ধর মধ্যপ্রাচ্য দেশ কুয়েতে চলে যান। এরই মধ্য ৩ বোনকে বিয়ে দেন। তারপর নিজে দেশে এসে একই উপজেলার কুর্শি ইউনিয়নের ভুবিরবাক গ্রামের সূধা সূত্র ধরের মেয়ে হ্যাপী সূত্র ধরকে বিয়ে করে ঘরে তুলেন। এরপর ছোট বোন শিল্পি সূত্র ধরকেও বিয়ে দিয়ে দেন। বর্তমানে জীবন সূত্র ধর দু’কন্যা সন্তানের জনক।
জীবন সূত্রধর জানান,তার মায়ের কাছে স্ত্রী হ্যাপীকে রেখে তিনি কুয়েতে চলে যান। ছোট বেলা থেকেই জীবন কাছ থেকে তার মায়ের কষ্ট দেখেছেন। তাই কোন ভাবেই সে তার মাকে কষ্ট দিতে চায়না। প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসতেন মাকে। তিনি দেশে ঘরচের জন্য সব টাকা পয়সা স্ত্রীর কাছে নয়। মায়ের কাছেই দিতেন। এতে খুশি ছিলেননা তার স্ত্রী হ্যাপী সূত্র ধর। এ নিয়ে বউ শাশুরীর মধ্য প্রায়ই ঝগড়া হত।
বিভিন্ন অজুহাতে বৃদ্ধা শাশুরী নীলুকে নানা নির্যাতন করত হ্যাপী। কিন্ত তারপরও পুত্র জীবনকে কোন কিছু জানাতেননা মা নীলু।
এক পর্যায়ে হ্যাপী তার ২ শিশু সন্তান নিয়ে শাশুরীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যান। প্রথমত এ ব্যাপারে জীবনের আপত্তি থাকলেও পরে মায়ের কথায় তিনি সম্মতি দেন। কিন্ত বিদেশ থেকে খরচের টাকা মায়ের কাছেই দিতেন।
নীলু সূত্র ধর ইনাতগঞ্জ বাজার থেকে এক মাসের পণ্য সামগ্রী খরচ করে এনে বউ শাশুরী ভাগ করে নিতেন। এতেও খুশি ছিলেননা বউ হ্যাপী।
নীলু সূত্র ধর যেদিন খুন হন ওই দিন দুই সন্তানসহ পিতৃালয়ে ছিলেন হ্যাপী। মামলার বাদী শিল্পি জানায় ঘটনার সপ্তাহ আগে হ্যাপী বাপের বাড়ীতে ছিলেন।
যে ভাবে খুন হন বৃদ্ধা নীলু সূত্র: ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল। শিল্পি সূত্র ধর এর এক সপ্তাহ আগে মাধবপুর স্বামীর বাড়ী থেকে ৫বছরের সন্তান নিয়ে ইনাতগঞ্জের ইছবপুর গ্রামে মায়ের কাছে এসেছিলেন। ওই দিন ছিল ইনাতগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে একদিনের বারুনী মেলা। বিকেল থেকেই অঝোরধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত প্রায় ৮টার সময় হঠাৎ করে ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের রাজনগর ভ’মিহীন গ্রামের অভিনাসের পুত্র রঞ্জিত দাশ নীলু সূত্রধরের বাড়ীতে উপস্থিত হয়ে দরজা খুলতে বলে। মামলার বাদী শিল্পি জানায় মা দরজা খুলে দিলে রঞ্জিত ঘরে প্রবেশ করে। এ সময় শিল্পি খাটে ঘুমিয়ে ছিলেন। নীলু সূত্র ধরের সাথে রঞ্জিত একি সুপার বসে গল্পও করেছে। নীলু সূত্রধর তাকে ভাত খেয়ে যেতেও বলেছেন।
এক পর্যায়ে নীলু ভাত আনতে পাকের ঘরে গেলে কোন কিছু বুজে উঠার আগেই পেছনে গিয়ে রঞ্জিত বৃদ্ধা নীলুকে চেপে ধরে। এ সময় মাকে বাচাতে শিল্পি এগিয়ে গেলে তাকে দাড়ালো অস্ত্র দিযে উপর্যুপরী তার ঘারে ও পেটে আঘাত ঘরে। অনুরুপভাবে বৃদ্ধা নীলুকে দাড়ালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত ঘরে। এক পর্যায়ে বৃদ্ধ নীলু সূত্রধর শরীরে আঘাত নিয়ে পেছনের দরজা খুলে প্রাণ বাচাতে বাহির চলে গেলে সেখানে ফেলে ঘার ও পেটে রক্তাক্ত আঘাত করলে ঘটনা স্থলেই তিনি মৃত্যু কুলে ঢলে পড়েন। গুরুতর আহত শিল্পিকে প্রেরন করা হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যদিও ঘাতক রঞ্জিত পুলিশকে বলছে দা দিয়ে আঘাত করেছে। কিন্ত আহত শিল্পি জানায় সেদিন দা নয় ছুরি দিয়ে সে আঘাত করেছে।
ঘটনার পরের দিন কুয়েত থেকে দেশে আসেন জীবন। এক সপ্তাহ ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে শিল্পি আসেন বাড়ীতে । ওইদিনই ইনাতগঞ্জ ফাঁড়ির ইনচার্জ শামছউদ্দিন ঘাতক রঞ্জিতকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতার পরবর্তী শিল্পি বাদী হয়ে নবীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন।
ঘাতক রঞ্জিত পুলিশের কাছে জবানবন্দী দেয় নীলু সূত্র ধরের কাছে সে ২০হাজার টাকা জমা রেখেছিল। ঘটনার দিন টাকা চাইতে গেলে শিল্পি ও তার মা নীলু তার উপর হামলা করে। প্রাণ রক্ষায় সে ও আক্রমন করে। এতে নীলু মারা যায়। আহত হয় শিল্পি। পরে রঞ্জিত আদালতে ১৬৪ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে।
কিন্ত রঞ্জিতের এ স্বীকারোক্তি অশ্বীকার করেন জীবন সূত্র ধর ও তার বোন মামলার বাদী শিল্পি ধর। তারা জানান,এ জবানবন্দী সম্পূর্ণ সাজানো। জীবন জানায়,আমার মাকে আমি মাসের মাস টাকা পাঠিয়েছি। টাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি জানান আমি পুলিশকে বারবার বলেছি এ ঘটনার সাথে অন্য কেউ জড়িত। অন্য কেউ বলতে তিনি তার স্ত্রী হ্যাপীর প্রতি ইঙ্গিত করেন। কিন্ত পুলিশ সেদিকে যায়নি। এক মাত্র রঞ্জিতকেই আসামী করে চার্জশীট দেয়া হয়েছে। জীবন জানান,আমি একমাস দেশে অবস্থান করে এসেছি। আমার স্ত্রী হ্যাপী তার বাপের বাড়ীতে রয়েছে। তার সাথে কোন যোগাযোগ নেই বলেও তিনি জানান। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন,সে কুয়েতে যাবার পর তার স্ত্রীর ভাইয়েরা তার বাড়ীতে এসে ঘরের তালা ভেঙ্গে আসবাব পত্রসহ ঘরের সব কিছু নিয়ে গেছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন এটা কিসের ইঙ্গিত।
মামলার বাদী শিল্পি জানান,টাকার পাওনার বিষয় নিয়ে মাননীয় আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়েছে। আমি নারাজী দিব। প্রস্তুতি চলছে। আমি এ মামলার পূনতদন্ত চাই। আসল খুনি ধরা ছোয়ার বাইরে রয়ে গেছে। আমার চোখের সামনে আমার মাকে নি:শংসভাবে খুন করেছে রঞ্জিত। তিনি অন্য সংস্থার মাধ্যমে মামলাটি নিরপ্রেক্ষ তদন্ত করে খুনীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
এদিকে চার্জশীটে অন্তর্ভুক্ত ৫জন সাক্ষি গত রোববার আদালতে উপস্থিত হয়ে এফিডেভিট প্রদান করেছেন। এফিডেভিডে উল্লেখ করেন নিহত নীলু সূত্রধরের কাছে টাকা পাওনার বিষয়টি তারা জানেনা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শামছদ্দিন খাঁন জানান,হত্যাকান্ডের পরপরই রঞ্জিতকে গ্রেফতার করি। নিহত নীলু সূত্র ধরের কাছে তার ২০হাজার টাকা জমা ছিল। ঘটনার দিন টাকা চাইতে গেলে নীলু ও শিল্পি তার উপর চড়াও হয়। এক পর্যায়ে রঞ্জিত তাদের উপর দা নিয়ে আক্রমন করলে ঘটনা স্থলে নীলুর মৃত্যু হয়। আহত হয় শিল্পি। এ ব্যাপারে রঞ্জিত মাননীয় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।দীর্ঘ তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেছেন বলে তিনি জানান।
Leave a Reply