-
- জাতীয়
- নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা-ড. মীজানুর রহমান
- আপডেট টাইম : January, 9, 2019, 8:57 am
- 566 বার
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় জয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। ৪৭ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে। নতুন সরকারের কাছে জনতার প্রত্যাশা অনেক। অনেকের মনে প্রশ্ন বিরোধী দল কেমন হবে? সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবে একটি বিরোধী দল কাম্য। কেননা বিরোধী দল সরকারের বিভিন্ন বিল ও প্রস্তাবনার পক্ষে-বিপক্ষে গঠনমূলক বক্তব্য প্রদান করে, যা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিরোধী দলকে গণতন্ত্রের প্রাণও বলা হয়। কিন্তু এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে সব সময় সংসদে থাকতে হবে। অর্থাৎ সরকারের বাইরে সংসদে যে দলই থাকবে, শুধু তারা বিরোধী দল হিসেবে গণ্য হবে—এমন ধারণা সঠিক নয়। বিরোধী দল সংসদের বাইরে অবস্থান করেও ভূমিকা পালন করতে পারে। সংসদের বাইরে অবস্থান করেও তারা জোরালো ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে, সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনা করবে এবং গণমানুষের বক্তব্য জোরালোভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ থাকবে। অর্থাৎ সরকারের নানা ইস্যুতে সংসদের বাইরে থেকেও তারা বক্তব্য দিতে পারবে। এখন কেউ যদি মনে করে, সংখ্যা বিবেচনায় সংসদে বিরোধী দলের জোরালো অবস্থান নেই, সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি এমন ধারণা সঠিক নয়। তারা শুধু সংসদে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিতে পারবে না; কিন্তু সংসদের বাইরে তারা ঠিকই বক্তব্য দেবে। অতীতে আমরা দেখেছি, খুব কমসংখ্যক সংসদ সদস্য নিয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা যায়। দুই থেকে তিনজন সংসদ সদস্য নিয়েও বিরোধী দল অতীতে দেখা গেছে। যেমন—সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত। তিনি একাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছেন। অতীতে আমরা দেখেছি, অনেক বড় বিরোধী দল, যাদের সংসদ সদস্যের সংখ্যা শতাধিক, তারা জাতীয় সংসদে যায়নি এবং কথা বলেনি। অনেকসংখ্যক সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দল অনবরত সংসদ বর্জন করেছে—এমন নজিরও রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে দূরদৃষ্টি নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্নপূরণে কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন, তা যেন বাস্তবায়িত হয়, সে ক্ষেত্রে নতুন মন্ত্রীদের নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রমাণ রাখতে হবে। বিগত দিনে আমরা এমন অনেক মন্ত্রীকে দেখেছি, যাঁরা শুধু রুটিন ওয়ার্ক করতেন।
বর্তমান সরকারের কাছে জনতার প্রত্যাশা অনেক। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, সরকারকে প্রথম গুরুত্ব দেওয়া উচিত ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। আমাদের প্রবৃদ্ধির পরিমাণ সম্প্রসারিত হচ্ছে, এখন দরকার এর সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ানো। তরুণ প্রজন্ম, যাদের আমরা ডেমোগ্রাফিক্যাল ডিভাইডেন্ড বলছি, তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। এর মাধ্যমেই আমাদের টার্গেট ২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে ধনী দেশ হবে। এসব টার্গেট অর্জন করার জন্য আমাদের ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে দেশের বিপুলসংখ্যক লোক বেকার। তারা কাজ পাচ্ছে না। আরেক দিকে আমাদের দেশের কাজ করার জন্য বিদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক লোক নিয়ে আসতে হচ্ছে। দেশে এখন কয়েক লাখ বিদেশি দক্ষ লোক কাজ করছে।
আমাদের যারা মেধাবী তরুণ, তাদের জ্ঞান রয়েছে। কিন্তু দক্ষতার বড় অভাব। অর্থাৎ তারা কাজটি সঠিকভাবে করার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাত্ত্বিকভাবে তারা খুব ভালো করবে। কিন্তু ব্যাবহারিকভাবে কাজ করার জন্য তাদের যে দক্ষতার দরকার ছিল, সেই শিক্ষা আমাদের তরুণরা পায়নি। তাই আমাদের কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব কাজ তরুণরা করবে, সেসব কাজের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ জন্য অবিলম্বে আমাদের কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সত্য; কিন্তু সেই সঙ্গে শিক্ষার মানগত প্রসারতাও বাড়াতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় থাকার পরও আমাদের যে পরিমাণে দক্ষতার উন্নয়ন করা দরকার ছিল, তা হয়নি। সে জন্য কারিগরি, প্রকৌশল প্রশিক্ষণের দিকে আমাদের যেতে হবে। আশা করি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কারিগরি ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ নিশ্চিত হবে। দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স দেখানোর পরও দুর্নীতি শেষ হবে না, বরং দুর্নীতি কিছু থেকেই যাবে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা যখন উন্নয়নশীল ধারায় থাকে তখন রাষ্ট্র কতগুলো স্তর অতিক্রম করে, তার একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে দুর্নীতি। যতটা সম্ভব দুর্নীতি মিনিমাম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।
আগামী ১০০ দিনের মধ্যে সরকারকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে বিষয় দৃশ্যমান করতে হবে, তা হলো—দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় না দেওয়া। আর এর চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দুর্নীতি করে মানুষ যেসব টাকা উপার্জন করেছে, তা যেন বিদেশে যেতে না পারে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, দুর্নীতিবাজরা টাকা বিদেশে পাচার করে। দুর্নীতি করেও অর্থ যদি দেশের ব্যাংকে রাখত কিংবা বিনিয়োগ করত, তাহলে সুফল পাওয়া যেত। কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির টাকা দেশে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো। কিন্তু দুর্নীতির টাকা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিভিন্ন কায়দায় মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে পাচার করে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ট্যাক্স নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, যে হারে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, গড় আয়ু বাড়ছে, সে হারে কিন্তু ধনী-দরিদ্রের সমতা বাড়ছে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম একটি দিক হলো ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সমতা আনয়ন। বাংলাদেশ একটি সাম্যের দেশ হবে। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান কমাতে হবে। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার অবশ্যই শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, সামাজিক নিরাপত্তার যে নেটওয়ার্ক আছে, তা আরো জোরালো করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন—কোনো মানুষ গৃহহারা থাকবে না, না খেয়ে থাকবে না, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে না—তার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা বলয় আরো জোরালো করতে হবে। এ জন্য অর্থের সংস্থানের লক্ষ্যে সবাইকে ট্যাক্সের নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply