প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ইতিহাসে ভরপুর প্রজাতপুর গ্রাম

ডেস্ক নিউজ ;;

প্রজাতপুর শব্দের অর্থ হলো—‘জনগণের নগর’। এই নাম শুনলেই মনে হয় এটি কোনো শহর, কিন্তু বাস্তবে এটি এক নিরিবিলি গ্রাম। ‘প্রজা’ মানে জনগণ, আর ‘পুর’ মানে নগর বা বসতি। অর্থাৎ, এই নামটি শুধু একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক অবস্থান নয়, বরং একটি দর্শনের প্রতিফলন—যেখানে জনগণের সম্প্রীতি, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের সহাবস্থান, এবং সম্মিলিত জীবনধারার এক অনন্য ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। সম্ভবত অতীতে এই গ্রাম ছিল একটি কেন্দ্রীয় স্থান, যেখানে আশেপাশের গ্রামের মানুষ একত্রিত হতো, যার কারণে একে বলা হতো “প্রজাতপুর”—জনগণের মিলনস্থল বা নগর।

হবিগঞ্জের এক কোণে, এক টুকরো গ্রাম—প্রজাতপুর। নাম শুনলেই যেন মনে হয় কোনো শহর। কিন্তু এ ‘নগর’ নয়, এটি এক আদিগন্ত  গ্রাম। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত এই গ্রামটি যেন প্রকৃতির কোলে জন্ম নেওয়া এক নিঃশব্দ কবিতা। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—নাম ‘প্রজাতপুর’ কেন? কী এমন ছিল এই গ্রামে যে একে বলা হলো “জনগণের নগর”?

শুধু একটি নাম নয়, এই নামের পেছনে লুকিয়ে আছে আত্মার বন্ধনে জড়ানো প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের ইতিহাস। পূর্বদিকে ছিল এক সময়কার প্রবল স্রোতের নদী নরখাই। এখন যদিও সে শুকিয়ে গেছে, একসময়ের জীবনধারার মূল ভরসা ছিল এই নদীই। বর্ষাকালে যখন গ্রামের রাস্তাঘাট ডুবে যেত, তখন নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। ছাত্র-ছাত্রীরা নৌকা করে যেত স্কুলে, কৃষকেরা আনত তাদের ফসল, পাশাপাশি সবাই যেত হাটবাজারে।

নরখাই শুধু যাতায়াত নয়, ছিল সাশ্রয়ের হাতিয়ারও। বাড়িঘর তৈরি করতে যখন দরকার হতো ইট-বালু-রড, তখন সেগুলো সহজেই নদীপথে চলে আসত ঘাটে। টাকা বাঁচত, সময়ও।

পশ্চিমে রয়েছে এক বিশাল হাওর। বর্ষায় এটি পরিণত হয় সাগরের মতো বিশাল জলের আধারে, আর হেমন্তে সেই জল সরে গিয়ে জেগে উঠে উর্বর জমি—শতশত বিঘার বিস্তৃতি। এই হাওরে শুধু প্রজাতপুর নয়, পাশের কয়েকটি গ্রামেরও জমি রয়েছে। ধান কাটা শেষে গরুর পাল নিয়ে রাখালদের যে উৎসবমুখর চিত্র দেখা যেত, আজ তা স্মৃতি হয়ে আছে শুধুই গল্পে।

এ গ্রামের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি গন্ধে মিশে আছে অতীতের নির্যাস। হাওরের পাড় ঘেঁষে যে মাটির পথ ধরে বাড়িঘর গড়ে উঠেছে, তা যেন প্রকৃতির আঁকা ছবি। গ্রামের বয়স্করা আজও বলেন—“নরখাই নদী, হাওরের জল আর মাটির উর্বরতা—এই তিনে গড়া আমাদের জীবন।”

নতুন প্রজন্ম মোবাইলে ব্যস্ত, শহরের মোহে অভ্যস্ত। কিন্তু যখন তারা শোনে পুরনো দিনের কথা—নৌকাবাইচ, ধানের মৌসুম, রাখালের বাঁশি—তখন তারা বুঝে যায়, এই মাটিই তাদের শেকড়।

প্রজাতপুর—এটি শুধু একটি গ্রামের নাম নয়। এটি ইতিহাসের এক জীবন্ত অংশ, যেখানে হারিয়ে যাওয়া নদী, আজও দুলে ওঠা হাওর, আর হাজারো মানুষের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রচিত এক ভালবাসার গাঁথা। এই গ্রাম আমাদের শেখায়—নগর না হয়েও কীভাবে একটি গ্রাম হতে পারে ‘জনগণের নগর’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ জাতীয় আরো খবর..

ফেসবুকে আমরা